লকডাউন ডায়রী
( ২য় পর্ব)
শুভজিৎ বন্দোপাধ্যায়
আবার ও একটা রবিবার এসে গেল। সকাল থেকেই হৈচৈ।
আমার ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরি হয়ে গেছে আর সেই সুযোগে ছোট ছেলের চুল কাটতে শুরু করেছে বৌ। কাটছে না কুপোচ্ছে বোঝা মুশকিল। বেগতিক দেখে আমার ডাক পড়ল। অনেক তাগবাগ করে পেছনে ঘাড়ের দিকে কিছু টা ছাটলাম। শেষমেষ ব্যপারটা একটা পর্যায়ে এলো।
বউ কে বললাম এটাও কি সোস্যাল মিডিয়ায় যাচ্ছে? আমার আরও একটি রোজগারের ব্যবস্থা, হবে নাকি? বারবার অর্থাৎ নাপিত।কি বলো?
বউ চিন্তা ভাবনা করে বললো “এখন সোস্যাল মিডিয়ায় দিলে তারপরই যদি পাড়ার থেকে ছেলেপিলেদের পাঠাতে শুরু করে তখন সোস্যাল ডিস্টান্সিঙের কি হবেএই লকডাউনের বাজারে?”
সত্যি, কি দূরদর্শী বউ আমার!
দুপুরে একটু গড়িয়ে নিয়ে সন্ধ্যায় আমাদের পাড়ার গলিতে হাঁটছিলাম।
আমার পুরানো গুরু র সাথে মন্দিরে দেখা। পাড়ার সিনিয়র দাদা। আমাদের ছোটবেলার কোচ কাম লিডার।
বিড়ি টানছে। গন্ধ টা আমার বিটকেল লাগে। কি আর করি, হাত নেড়ে ডাকলো তাই পাশে এসে বসলাম।
“তোর কথাই ভাবছিলাম”।
গুরুর এটি অনেক পুরনো অভ্যাস। দেখলেই বলে, “তোর কথাই ভাবছিলাম”।
বললাম কেন, কি ব্যাপার?
চল্ আমার সাথে খালের পুকুরে, তাড়ুই মাছ ধরবো। তাড়ুই মাছ বাজারে আর পাওয়া যায় না। আমাদের এলাকায় এখনো আছে! অবাক লাগে।
গুরু আমার মেদিনীপুরের লোক। ছিপ,জাল,ঝুপি, ইত্যাদি মাছ ধরার হাজার কৌশল আর লক্ষ্য উপাদান ওর কাছে মজুত।
এতরাতে ঐ দিকে সাপ খোপের আড্ডায়? এখন কি আর সেই বয়স, সেই সব দিন আছে?
তুই চল।বেশি দিগগজ হয়েছিস বুঝি?
অন্ধকারে পুকুরের পাড়ে আমাকে দাঁড় করিয়ে বাবু গেলেন জোগাড় আনতে।
খানিক বাদে বগলে একটা মাদুর, হাতে একটা জ্বলন্ত কেরোসিনের টিনের লম্প নিয়ে হাজির।
এখন টর্চের যুগে এই লম্প দূর্লভ।
আমি লম্প ধরলাম। আমার গুরু দা পুকুরের ঘাটে হাঁটু পর্যন্ত নেমে মাদুর টা জলের ওপর বিছিয়ে দিল।
আমার হাত থেকে লম্প নিয়ে সাবধানে বসালো মাদুরের ঠিক মাঝখানে। দক্ষিণ দিকের বাতাসে মাদুর ভেসে চললো
লম্প নিয়ে পুকুরের মাঝ বরাবর।
হটাৎ অবাক হয়ে দেখলাম পটাপট করে মাছ লাফিয়ে লাফিয়ে ঐ মাদুরে পড়ছে। কয়েক মিনিটে অন্তত তিরিশের বেশি তো কম নয়। এমন ভাবে মাছ ধরার কৌশল জানা ছিল না।
কিন্তু মাদুরটা আবার আনবে কি করে?
তাকিয়ে দেখি ইতিমধ্যেই মাদুর আসছে আমাদের দিকে এগিয়ে। ওর দুই কোনে দুটো দড়ি বেঁধে ভাসানো হয়েছিল।
তখন অন্ধকারে খেয়াল করিনি।
এই জন্যই গুরুদা চিরকাল আমাদের গুরু। এই সব কাজে ওর জুড়ি মেলা ভার। তবে বিয়ে ও করেনি আর চাকরির চেষ্টা ও করেনি কোনো কালে। বাপ ঠাকুরদার পুকুর, বাগান নিয়েই এলোমেলো বাউন্ডুলে জীবন কাটিয়ে দিল বিড়িতে টান দিয়ে।
গুরুদা তোমার এই মাছ ধরার কৌশল টা কি?
জলন্ত বিড়ি টা জলে ছুড়ে দিয়ে বিড়বিড় করে গুরুদা উত্তর দিলো, “কি আর, ঐ আলোর নেশা দিয়ে শিকার ধরা।”
কি অদ্ভুত কথা! আলোর নেশা! কথা টি ছোট কিন্তু অদ্ভুত মাদকতাভরা।
ভাবতে ভাবতে কূর্চি ফুল আর মালতিলতার সুবাস বুকভরে নিয়ে ঘন জোনাকির অন্ধকার ঠেলে বাড়ি ফিরলাম।
*****
করোনা র আতঙ্কের মধ্যে ই আবার একটা সোমবার শুরু হলো।
এই কদিনে অফিসে না যাওয়ার ব্যাপারে বেশ অভ্যস্থ হয়েগেছি।
ভুলে গেছি বজবজ লোকাল, পার্ক সার্কাস স্টেশন, ধুলাগড় নিউটাউনের বাস, কলেজ মোড়। আমার জীবন থেকে এই সব যেন কোথায় হারিয়ে গেছে । আমার পূনরজন্ম হয়েছে।
আবার আমার পাড়া, আমার পুরানো স্মৃতি, পরিবেশে ফিরে এসেছি জীবনের মধ্যগগন অতিক্রম করে।
অদ্ভুত রহস্যময় মহাশক্তির এই লীলা। মুহুর্তে সব ওলট পালট। সুনামীর মতো।
দুপুরে অফিসের কাজ নিয়ে খুব ব্যস্ত। হঠাৎ দমকলের ঘন্টার আওয়াজ। শুনেছি কিন্তু খেয়াল করিনি।
খানিক পরেই কারেন্ট চলে গেল।
আমি বাইরে এলাম। বাড়ি থেকে বেরিয়ে গলির মুখে আসতেই নাকে ধোঁয়া র গন্ধ পেলাম। লোকজন দলবেঁধে পাড়ার ভীতরের দিকে ছুটছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলাম ধোঁয়া উড়ছে।
তাড়াতাড়ি বাড়ি এসে মাস্ক নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
ব্যাপার টা কি জানতে হবে।
আমি তো অবাক। সুনীল দার গোডাউন ঘিরে লোক জন, দমকলের গাড়ি। পুলিশ।কিন্তূ দিনেদুপুরে আগুন লাগলো কি করে!
লোকজন বলছে,গোডাউনের পেছনে শুকনো উলুঘাসের জঙ্গলে কে নাকি বিড়ি সিগারেট ধরিয়ে ফেলেছিল সেখান থেকে আগুনের সূত্রপাত।
পড়ন্ত বিকেল। চলে আসব, এমন সময় পিছন থেকে গুরুদেবের ডাক।
“কি রে চলে যাচ্ছিস? আমি জানতাম তুই আসবি।”
তুমি তো সব ই জানতে । জানো কি আগুনটা লাগলো কি করে?
গুরুদার হাতে ঝুপির বড়বড় বড়শি। সেগুলো তে পাউরুটি আর পিঁপড়ের ডিম দিয়ে মাখা টোপ লাগাচ্ছে খুব যত্নসহকারে। আমার কথা টা যেন শুনতেই পেলনা।
বললো, “আজ সন্ধ্যায় একবার চলে আয়। একটা বড় কাতলা তুলবো এই ঝুপিতে। দশটা কাঁটা। ঠেকলেই কেল্লা ফতে।”
আমি আবার বললাম “কি করে এই আগুন লাগলো জানো? কি ছিল ভিতরে?
গুরুদা আমার চোখে চোখ রেখে বলল, “ঐ যে বলেছিলাম, আলোর নেশা। নেশা দিয়ে শিকার ধরা। এও তাই।
তবে। এই ঝুপি তে কিন্তু অন্য নেশা লাগানো। পরে বলবো। আসলে সব ই নেশার খেলা রে পাগলা।”
পরদিন সকাল থেকেই গোডাউনের সামনে মেলা বসে গেল। চাল আর আলু বিতরণ করা হচ্ছে এই অতিমারীর বিপর্যয়ের সময়।
নিন্দুকেরা বলছে বটে ওগুলো সব গোডাউনের আধপোড়া মাল। পুড়ে গিয়ে সব জানাজানি হওয়ার আগেই রাস্তা পরিষ্কার করে দিচ্ছে।
কার জিনিস! কখন এলো! কোথাথেকে এলো এইসব এলোমেলো প্রশ্ন তো চিরকালের। চলছে চলবে।
তবু যাইহোক এলাকার মানুষ কিছু তো পাচ্ছেন, অন্তত যতদিন এই সব গোডাউন গুলো বাস্তু সাপেদের সতর্ক পাহারার রয়েছে।