পঞ্চপান্ডবের সাথে কামেশ্বরী
শুভজিৎ বন্দোপাধ্যায়।
বিজয়া দশমীর দুপুরে অযোধ্যা পাহাড়ের হিলটপ থেকে আমাদের বোলেরো চললো ময়ুর পাহাড়ের দিকে। পথের মাঝে হালকা বৃষ্টি আর মেঘলা ছিল বলে গরমটা বুঝতে পারিনি।
পুরুলিয়ার ময়ুর পাহাড়, দেউলঘাটা,মুরগুমা ড্যম,এগুলো টুরিস্ট স্পট হিসেবে ইতিমধ্যেই বেশ পরিচিতি পেয়েছে। নেট খুললেই সব জানাযায়।
কিন্তু ঐ পথেই পড়বে “যোগিনী গুহা” অথবা নাম না জানা “কামেশ্বরী ফলস” যার কথা সচারাচর কোথাও লেখা হয়না হয়তো বা একটু বেশি বিপদের ঝুঁকি আছে বলেই।
পরে জেনেছি বলে আমাদের এযাত্রায় “যোগিনী গুহা” দেখা হয় নি তবে “কামেশ্বরী” তে পৌঁছোতে পেরেছি।
আমাদের গাড়ি র চালক ময়ুর পাহাড় হয়ে কিছু টা গাড়ি চালানোর পর একটা গ্রামের পথে ঢুকে গাড়ি থামিয়ে ডানদিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলল ঐ দিকে যেতে হবে। কামেশ্বরী”ফলস্ এর রাস্তা।
সে কিন্তু গাড়িতেই বসে রইলো।
আমরা দুটো মাটির বাড়ি র ফাঁক দিয়ে এগিয়ে গিয়ে একটা নীচু ছোট ছোট আগাছায় ভরা মাঠে এসে দাঁড়ালাম।
চারিদিকে জঙ্গলে ভরা। কোথায় পথ! কোনদিন যাবো!
এ তো মহামুশকিল। ফিরে যেতে হবে নাকি!!
হঠাৎই জঙ্গল ভেদ করে মাথায় ঝাঁটি নিয়ে এক মহিলা এগিয়ে এলেন।
“ছুয়া নিও, পথ দেখাবা”, অর্থাৎ এখানকার একটা ছেলে কে নাও সাথে যে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে।
ভগবান হয়তো এমন ভাবেই দেখা দেয়, আমরা বুঝতে পারি না।
যাইহোক আমার বড়ছেলে আবার ঐ পথে ফিরে গেল এবং কয়েক মিনিটের মধ্যে ই ফিরে এল “পঞ্চপান্ডব” কে সাথে নিয়ে। সব ক’টার ই বয়েস ছয় থেকে বারো’র মধ্যে।
খালি পা, হাতে ছোট ছোট লাঠি। জঙ্গল পেটাতে পেটাতে চলছে আমাদের আগে পিছে হাসি মুখে। কৌতুহলী দৃষ্টিতে মাঝে মাঝে আমাদের অর্থাৎ কোলকাতার বাবুদের দেখছে অবাক হয়ে।
অনেকটাই দুপুর গড়িয়ে গেছে। তার উপর বনজঙ্গল। মেঘলা আকাশ। কেমন যেন একটা বনজ গন্ধ চারদিকে। চলতে চলতে জলের শব্দ অনুসরণ করে হাজির হলাম জলধারার সামনে। এই বছর বর্ষার দাপট ছিলনা বলেই হয়তো কামেশ্বরী একটু বেশি শান্ত । হুড্রু,জোনা এমনকি আপার ড্যামের পাশে অবস্থিত বামনি ফলসের সাথে ও এর তুলনা চলবে না।
তবু এর মাদকতা এর নামে, এবং উথলে ওঠার ঠমকে।
সবার চোখে সে ধরা দেবে না, রহস্যময়ী হয়ে থাকবে জীবন ভোর এই যেন তার শপথ।
নিরিবিলি, ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক,বড় বড় শাল, সেগুন,কেন্দু, ইউক্যালিপটাস এবং আরো অনেক গাছের শান্ত সহাবস্থান আমাদের চারপাশে।
আরো খানিকটা এগুলে ভালো হতো, কিন্তু সাহসে কুলালো না।
অন্ধকার ঘন হচ্ছে। বৃষ্টি এলো বলে।
কি আর উপায়, ফিরে এলাম পঞ্চপান্ডব কে নিয়ে।
“কি রে কত টাকা দেব?”
“দশ,বিশ যা পার দিও” পঞ্চপান্ডবের একজন বললো।
প্রশ্ন করলাম,তোরা ইস্কুলে যাস?
একদম ছোটটা বাদে সকালেই ঘাড় নাড়ল।
পায়ে জুতা নেই। গায়ের পোশাক নেই বললেই চলে।
আরো অনেক কিছুই নেই এদের,তবে সকলের মুখে যে হাসিটা দেখেছিলাম তার দাম অনেক – টাকার বিনিময়ে তা আমার কেনার ক্ষমতা নেই।
গাড়ি ঘুরিয়ে চলে আসছি। এবারের গন্তব্য মুরগুমা। সামনের টিউবওয়েলে পঞ্চপান্ডব হাত পা ধুচ্ছে।
সব কটা মিলে গাড়ির দিকে তাকিয়ে স্যালুট করল হাসিমুখে, যেমনটি স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে আমরা দেখতে পাই।
সামান্য ক’টা টাকাই তো দিয়েছি, তাও তাদের পরিশ্রমের বিনিময়ে, তবুও এই স্যালুট!!
এটা সম্মান নাকি অপমান, কে জানে!
মন কে আর উপরওলা কে বললাম, আসব, আবার এখানেই আসব, এই অখ্যাত কামেশ্বরী’র কাছে, এই পান্ডব বর্জিত “পঞ্চ পান্ডবদের” গ্রামে, তবে কিছুটা আগামপ্রস্তুতি নিয়ে।এমন খালি হাতে ভিখারীর মতো ভিক্ষা নিতে নয়।