বাবার কথা
শুভজিৎ বন্দোপাধ্যায়
তখন উড়িষ্যায়।
পূজোর ঠিক আগে।
সন্ধ্যায় বড় ছেলে কে পড়াচ্ছি।
আমার মানা আর সান্ত্বনা রান্না ঘরে বিশেষ কোনো আবিষ্কারে ব্যস্ত।
ছোট ছেলে তখন খুব ই ছোট, ঠিক মতো হাঁটতেও শেখে নি।
বাবা তাকে কোলে নিয়ে বাইরে বেড়াচ্ছিলেন।
কিছু সময় পর হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠলো।
ল্যান্ডলাইন।
ধরলাম। উদ্বিগ্ন গলায় আমার এক বন্ধু বলল
” দাদা জলদি আইয়ে পিতাজী গির গিয়া”
দুর্গাপূজা মণ্ডপে ইলেকট্রিক নিয়ে যাওয়ার জন্য একটা সরু এবং লম্বা গর্ত খুঁড়ে রাখা হয়েছিল।
সম্ভবত চতুর্থী বা পঞ্চমীর দিন। আলোকিত চারিদিক।
বড় বড় আলো সব ই রাস্তার দিকে মুখ করে লাগানো। সব ঠিকঠাক সাজানো হয়নি। কাজ চলছে।
চোখ ধাঁধানো আলোর মধ্যে আমার বাবা তাঁর পরম আদরের নাতি কে বুকে নিয়ে সেই দুর্গা মন্ডপের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন।
প্রতিদিনের চেনা পথে যে এমন বিপদ লুকিয়ে আছে গর্ত খুঁড়ে রাখা হয়েছে তা তিনি ভাবতেও পারেন নি।
ঐ গর্তে পড়ে গেলেন।
চোট লেগেছিল বুকের পাঁজরে। কাঁধে, হাতে।
কিন্তু কোন চোট লাগতে দেন নি নাতির শরীরে।
কয়েকদিন পর একটু সুস্থ হয়ে বলেছিলেন
“সিংহ মশাইয়ের গায়ে কোন আঁচড় পড়তে দেব না বলেই আমি ওকে কোল থেকে ছাড়ি নি।
একা থাকলে ঠিক সামলে নিতাম”
সিংহ মশাই নাম টা বাবা দিয়েছিলেন আমার ছোট ছেলেকে।
এই আমার বাবা।
সকলের জন্য কেবল দেওয়া। বিলিয়ে দেওয়া।
কখনো কিছু পাওয়ার আশায় না রেখেই।
ছাত্র ছাত্রীদের পড়ানোর সময় ও দেখতাম কি ভীষন আগ্রহ আর আন্তরিকতা।
এক ই কথা বারবার বলে বলে মাথায় ঢুকিয়ে না দেওয়া পর্যন্ত তাঁর দায়িত্ব শেষ হতো না।
জীবনের শেষ মুহূর্তে পৌঁছেও সেই মানুষ টা বলেন না আমাকে বাঁচাও ।
তার পরিবর্তে বলেন “তোমার মায়ের খেয়াল রেখো। নাতিদের পড়াশোনার খেয়াল রেখো”
“যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে”
বাবার প্রিয় গানের একটি।
“ব্রাহ্মণ মুহূর্তে মাঝে ঝাঁপ দিল জলে
আর উঠিল না
সূর্য গেল অস্তাচলে”
বাবার অন্যতম প্রিয় কবিতা “দেবতার গ্রাস”
পুরো টাই মুখস্থ বলতে পারতেন একসময়।
মনে পড়ে, ছোটবেলায় গরমের লোডশেডিং এর রাতে খেয়ে দেয়ে বিছানায় শুয়ে থাকতাম।
জানালা দিয়ে দখিনা বাতাস আসছে।
কখনো বা চাঁদের আলো। ঝিঁঝিঁ ডাকা স্তব্ধতা।
বাবা খাটের পাশে পায়চারী করতে করতে বিভিন্ন কবিতা বলে চলেছেন।
কখনো কখনো ধুতির খুঁট দিয়ে চোখ মুছতেন।
আবছা আলোয় দেখতে পেতাম।
কবিতার অর্থ সব ই যে বুঝতাম তা না, কিন্তু আবৃত্তি শুনতে ভালো লাগতো।
কখন যে ঘুমিয়ে পড়তাম!!
উত্তমকুমারের সিনেমা দেখলেও বাবা হাপুস নয়নে কাঁদতেন। বলতেন স্বতস্ফুর্ত আবেগের বহিঃপ্রকাশ না হলে এই সব সাহিত্য সিনেমা সব ই বৃথা।
আমরা হাসতাম সেই কান্না দেখে।
বাবা র জীবনের পুরোটাই শিক্ষনীয়।
সিলেবাসের শিক্ষক নন, জীবনের শিক্ষক আমার বাবা।
আজ থেকে ঠিক এগারো বছর আগে এই দিনে এই তারিখে বাবার চলে যাওয়া।
“এমন একান্ত ছেড়ে যাওয়া”
এখনও চলতে চলতে হোঁচট খেলে আগে বাবার কথাই মনে পড়ে।
তার পর রবীন্দ্রনাথের গান ও কবিতা সেই ব্যথার মলম হয়।
এই চিকিৎসা পদ্ধতি টাও বাবার ই শেখানো।