Lock down stories

লকডাউন ডায়রী | Lock down Diary (Part 1)

লকডাউন ডায়রী
( প্রথম পর্ব)

শুভজিৎ বন্দোপাধ্যায়

মার্চে’র শেষ।

লকডাউন শুরু র প্রথম সোমবার। সকাল সাতটায় ঘুম থেকে উঠলাম। আজকে আর এ্যলার্মের দরকার নেই। নেই ভোর থেকেই অটো বাস ট্রেনের ঝুলোঝুলি করে অফিসে দৌড়।

কোনো গাড়ির আওয়াজ, কোন তীব্র হর্ন ও কানে আসছে না।

পরিবর্তে কোকিল, শালিকের ডাক, ডাকপাখি ছাতারে পাখিদের ডাক ভরিয়ে দিয়েছে সকালের আকাশ।

আমাদের এই যায়গাটা একটু মফস্বল এলাকা। পাড়ার আসপাশে এখনো কিছু গাছপালা, পুকুর ঝোপ ঝাড় অবশিষ্ট আছে।

আনন্দ’দা বলছিল কয়েক দিন আগেই সন্ধ্যার সময় একটা চন্দ্র বোড়া দেখেছে খালের পুকুরের ধারে। হাত দুই লম্বা গায়ে চাকা চাকা দাগ। রাস্তা পার হয়ে সুনীলদার গোডাউনের লোহার দরজার তলা দিয়ে ঢুকে গেল নড়েচড়ে। গোডাউন তো নয় যেন সাপ খোপ আর ভুতের বাসা। পিছনে বন জঙ্গল।মাঝেমাঝে খোলাহয় বুঝতে পারি যখন রাত ভিতে দু একটা লরি আওয়াজ করে পাড়ার ভীতরে যায় অথবা আসে। এমন নিরিবিলি যায়গাতেই যে বিষধর বাস্তুসাপের আড্ডা হবে তা সহজেই অনুমেয়।

সকাল সাড়ে নটা নাগাদ অফিস থেকে বসে’র ফোন।

“কি ব্যাপার, কি করছো?

বললাম “লকডাউন বলে আজ খবরের কাগজ ও আসেনি।

এতকাল সকালের কাগজটা পড়তাম রাতে অফিস থেকে ফিরে। ভাবলাম এবার হয়তো টাটকা কাগজ পড়ার সুযোগ হবে ক’টা দিন। কিন্তু বিধিবাম।”

বস গলা পরিষ্কার করে বললেন,”আমাদের কমপ্লেক্সে তো খবরের কাগজ ঢোকাই বারণ। কাজের লোকের আসাও বন্ধ। অভ্যস্ত জীবন সব এলোমেলো অবস্থায়।

যাক্, শোনো, আমাদের অনলাইনেই অফিসের কাজ চালিয়ে যেতে হবে। তোমাকে মেল করেছি, দেখে নিও। পরে আমাকে ফোন কোরো কোনো অসুবিধা থাকলে। এখন কিছু দিন এভাবেই চলতে থাক ।”

শুরু হলো আমার ওয়ার্ক ফ্রম হোম। ল্যাপটপের পর্দায় চোখ রেখে চলে গেলাম অফিসের জগতে।

এতদিন এতগুলো বছর অফিস গিয়ে বাড়িকে ভুলে ছিলাম। এবারে নতুন শিক্ষা, বাড়িতে থেকেই বাড়ি’ কে ভোলার অভ্যাস শুরু হলো।

আমার বড় ছেলে’র ও অনলাইনে কলেজের ক্লাস চলছে।

কয়েকদিন আগে থেকেই শুরু হয়েছে।

দুজন পাশাপাশি দুই টেবিলে, যেন অফিস কলিগ।

টিভি চালালে করোনা ছাড়া আর কোন খবর নেই।

তার চেয়ে অফিসের কাজে অনেক শান্তি।

এখন আর নেই অফিসে হাজিরার তাড়া, নেই সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার তাগিদ। ভীড়, ধাক্কা,ধুলো, গালাগালি, ঠেলাঠেলি নাথিং!!

এমন সঙ্কটকালে এমন আরামদায়ক অফিস!

ভাবতেই অবাক লাগে।

শুধু কি আমার? ছেলের কলেজ ও নিউটাউনের শেষ প্রান্তে। যাওয়া আসাতেই অর্ধেক ক্যালোরী শেষ। আমাকে অনেক বার বলেছিল ওদিকে একটা ফ্ল্যাট নাও, না হলে আমাকে পিজির ব্যবস্থা করে দাও।

পয়সা যেন দেবদারু গাছ! ভর্তি পাতা। নাড়লেই ঝরবে।

যাক্ ভগবান মুখ তুলে চেয়েছেন। অন্তত যে’কটা দিন করোনার দাপটে সব কিছু বন্ধ থাকবে সেই সময়ে এই অনলাইনে কলেজ, সেমিস্টারের পরীক্ষা, অফিস সব কিছুই একদম মাখন! নো ছুটোছুটি,নো হুটোপুটি।

*******

আজ পূর্নিমা।

সকাল সাড়ে পাঁচটায় আমার বউ ঘুম ভাঙিয়ে বললো “তাড়াতাড়ি চান করে নাও। আটটার মধ্যে সত্যনারায়নের সিন্নি টা দিয়ে দেবে। এখন কোন পুরোহিত মশাই ডাকা যাবে না। পাঁচালী টা’ও পড়তে হবে। ”

বললাম,” আর দক্ষিণা টা?”

“হাঁ, তাও পাবে।”

পূজা করলাম। দক্ষিণা ও পেলাম।

একশো এক টাকা!

সোস্যাল মিডিয়ায় আমার পূজা করার ছবি আপলোড হলো। কয়েক জন আমাকে পুরোহিত মশাই হিসেবে পেতে আগ্রহ প্রকাশ ও করলেন।

সত্যি মিথ্যে বোঝা মুশকিল তবু এই বিপদের সময় আমার একটা সাইড বিজনেসের সুযোগ তৈরি হচ্ছে। যাক্ রোজগারের চিন্তা নেই।

বাড়িতে কাজের মেয়েদের ছুটি ঘোষণা নিয়ে সোস্যাল মিডিয়ায় রীতিমত একটা প্রতিযোগিতা চলছে। কি আর বলব! ইতিমধ্যেই আমার পরিবারেও ফরমান জারি হয়েছে আগামী কাল থেকে আমাদের খাওয়ার থালা বাসন নিজেকে ধুয়ে নিতে হবে। আস্তে আস্তে আরও কতকিছু শিখতে হবে কে জানে! সব ই কাজে লাগবে হয়তো।

পাড়ার কয়েকজন দাদা, দাড়ির নীচে মাস্ক ঝুলিয়ে চাল, ডাল, আলু বিতরনের ছবি দিয়েছেন সোস্যাল মিডিয়ায়।

অনেক সুন্দরী বৌদিরা আবার রকমারি সব রান্না র পোস্ট করেছেন। শাড়ি, চশমা, ছোটবেলা বনাম বুড়ি বেলার ছবি পোস্ট করেছেন। কতরকম সব উদ্ভাবনী চিন্তা ভাবনা। ভাগ্যিস এই মিডিয়া গুলো জন্মেছিল। তবুও এই সব কাজ কর্মে মানুষের লকডাউনের একঘেয়েমি তো কাটে।

********

শনিবার। সন্ধ্যা হল। ভাবছি এবার একটু ল্যাপটপ টা ছেড়ে সামনের গলিতে হেঁটে আসবো। বাঙলার দিদি আর দিল্লির দাদা নতুন কিছু বললেন কি’না জানতে হবে।

হঠাৎ চুলের মুঠি ধরে আমার ছোট পুত্র কে সামনে এনে হাজির বৌ।

“পই পই করে বারণ করেছি সাইকেল নিয়ে না বের হতে।

মোড়ের মাথার ওখানে কা’দের একটা চেন খোলা কুকুরের গায়ে ধাক্কা মেরে রাস্তায় পড়েছে। হাত , হাঁটু ছড়েছে। জানিনা কুকুরের আচড় লেগেছে কি না। তিন মাস হয়নি হাতের প্লাস্টার টা খোলা হয়েছে। অসভ্য ছেলে।”

ছেলের হাতে পায়ে নজর দিলাম। বিভিন্ন ধরনের আঁকি বুকি পেন দিয়ে।

বললাম ” এই সব কি করেছিস!!”

ছেলে বললো ” ট্যাটু”

মা এর জবাব ” বাঁদরের বাঁদরামি। এক মাথা চুল। স্কুলের পাট তো এখন নেই। লেখাপড়ার নামে সারাদিন এই সব।

কাল ই ওর চুল কেটে দেবে। ”

আমি তদন্তের আস্বাস দিলাম অর্থাৎ এখন ই ঘটনাস্থলে গিয়ে ছেলে কোথায়, কিভাবে পড়েছে, কুকুরের আচড় লেগেছে কি না ইত্যাদি সব কিছু জেনে আসার আশ্বাস দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিলাম।

পাড়ার মোড়ে আসতেই হট্ নিউজ। কোথায় যেন রেশনের চাল গম দেওয়া নিয়ে মারামারি হয়েছে। কোনখানে আবার ক্লাবের উদ্যোগে চাল, ডাল, আলু এই সব বিতরণ হচ্ছিল। সেই মাল থেকেও লোকজন নিজের জন্য সরিয়েছে, নিজেদের লোক কে পাইয়ে দিয়েছে। এই সব ই এখন খবর।

অন্ধকার হয়ে গেল। ফিরে আসছি।

পাশ দিয়ে মন্জা পাগলা দার্শনিকের মতো বলতে বলতে যাচ্ছে”আজ বাদে কাল সব ঘাটে উঠবে এখনও ঝেড়ে যাচ্ছে।

সব মাল গোডাউনে পচবে। সব পচে মরবে।

সব শেষ….সব শেষ।”